বাবা-মায়ের সাথে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে প্রথম সূর্যোদয় দেখা অসাধারণ ছিল, কি ছিল সেই অভিজ্ঞতা তা তোমাদের জানাবো। আমি রিশাদ। বয়স ১১ বছর। আমি ঢাকায় থাকি এবং এখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। অনেকদিন ধরেই বাবা-মায়ের কাছে অনুরোধ করছিলাম যেন আমাকে কক্সবাজার নিয়ে যায়। আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে শুনেছিলাম, “কক্সবাজারের সমুদ্র নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা বালুকাবেলা।” তখন থেকেই আমার মন কেমন করে উঠেছিল-সমুদ্রটা একবার নিজের চোখে না দেখলে যেন শান্তি নেই।
আরও: ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা প্রথম সকাল
একদিন রাতে খাওয়ার টেবিলে বাবা বলল, “রিশাদ, এবার ঈদের ছুটিতে আমরা কক্সবাজার যাব।” আমি তখন খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম! মা বলল, “তুমি কিন্তু ঠিকমতো ব্যাগ গোছাতে হবে আর কাপড়-চোপড় গুছিয়ে নিতে হবে।” আমি তখন থেকেই দিন গুনতে লাগলাম কখন সেই বিশেষ দিনটি আসবে।
অবশেষে সেই দিনটা এল। আমরা ঢাকার কমলাপুর থেকে রাতের ট্রেনে চেপে প্রথমে চট্টগ্রাম গেলাম। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অনেকক্ষণ চুপচাপ ছিলাম। গ্রামের বাড়ি যাওয়ার সময়ও ট্রেনে যাই, কিন্তু এই যাত্রাটা ছিল আলাদা। চট্টগ্রাম পৌঁছে আমরা বাসে করে কক্সবাজার যাত্রা শুরু করলাম। চারপাশের পাহাড় আর প্রকৃতির দৃশ্য দেখে আমার মনটা হালকা হয়ে গেল। সবকিছু এত নতুন, এত সুন্দর লাগছিল যেন আমি কোনো রূপকথার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি।
আমরা কক্সবাজার পৌঁছালাম বিকেলের দিকে। হোটেলে চেক-ইন করে একটু বিশ্রাম নিয়েই চলে গেলাম সমুদ্রসৈকতে। হোটেল থেকে মাত্র ৫ মিনিট হাঁটার পথ ছিল। আমি প্রথমবারের মতো নিজের চোখে বিশাল নীল সমুদ্র দেখলাম। ঢেউয়ের শব্দ শুনে আমার শরীর যেন কেঁপে উঠল আনন্দে। বাবা বললেন, “এই যে রিশাদ, তোমার স্বপ্ন পূরণ হলো!” আমি দৌড়ে গিয়ে পা ভিজিয়ে ফেললাম। বালুর উপরে হেঁটে হেঁটে আমরা সূর্যাস্ত দেখলাম। সেদিনের সূর্যটা ছিল একেবারে লাল আর মেঘের ফাঁকে ফাঁকে হারিয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। মা ছবি তুলছিলেন, আর আমি কেবল দুচোখ দিয়ে সেই রূপ ধরে রাখার চেষ্টা করছিলাম।
পরদিন সকালে বাবা বলল, “আজ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হবে। আমরা সমুদ্রের সূর্যোদয় দেখতে যাব।” আমি তখনই ঘুমাতে গেলাম, যদিও উত্তেজনায় ঘুম কিছুতেই আসছিল না। ভোরবেলা মা আমাকে ডেকে তুললেন। ঘড়িতে তখন ৫টা। বাইরে তখনও অন্ধকার, কিন্তু সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছিল। আমরা দ্রুত হোটেল থেকে বেড়িয়ে সৈকতের দিকে হাঁটতে লাগলাম।
আরও: আমার চোখে ঢাকা শহর
হঠাৎ এক সময় দেখলাম আকাশ একটু একটু করে আলো হয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রের দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তারপরই হঠাৎ করে আকাশে সোনালি আলো ফুটে উঠল। আমি প্রথমবার জীবনে সূর্যোদয় দেখছি। সেই দৃশ্য ছিল অসাধারণ-সূর্যটা ধীরে ধীরে সমুদ্রের মাঝখান থেকে উঠছিল, আর তার আলো পানিতে পড়ে চিকচিক করছিল। মনে হচ্ছিল যেন পুরো পৃথিবী সোনালি হয়ে গেছে।
বাবা বলল, “এই মুহূর্তটাই তোমার জীবনের স্মরণীয় সময় হয়ে থাকবে, রিশাদ।” আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। কেবল চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। মায়ের হাত ধরেই দাঁড়িয়ে ছিলাম, যেন এই মুহূর্তটা কখনও হারিয়ে না যায়।
সেই দিনের পরে আমরা আরও দুই দিন কক্সবাজারে ছিলাম। আমরা মহেশখালী ঘুরে এলাম, যেখানে নৌকায় চেপে যেতে হয়। আমি প্রথমবার লাইফ জ্যাকেট পরে নৌকায় উঠলাম। নৌকার ভেতর ভয়ও লাগছিল, আবার মজাও লাগছিল। একপাশে পাহাড়, আরেকপাশে সমুদ্র-সব মিলিয়ে যেন স্বপ্নের জগতে ছিলাম।
আমরা ইনানী বিচেও গিয়েছিলাম। ওখানে পাথরের উপরে হেঁটে বেড়ানো ছিল এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। আমার পায়ের নিচে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা পানি আর পাথরের আলতো খোঁচা, সব কিছুই একসাথে ছিল আনন্দময়।
শেষদিন সকালে সৈকতের বালিতে বসে আমি আমার জুতা খুলে রেখে একাই অনেকক্ষণ বসেছিলাম। সমুদ্রের ঢেউ তখনো আসছিল, আর আমি ওদের দেখছিলাম। বাবার হাতে ধরা ক্যামেরায় একটা ছবি তোলা হয়েছিল তখন, যেটা এখন আমার ঘরের দেয়ালে টাঙানো।
কক্সবাজার ভ্রমণ শুধু একটা ট্রিপ ছিল না-এটা আমার জীবনের প্রথম সূর্যোদয় দেখার অভিজ্ঞতা, বাবা-মায়ের সাথে একসাথে ঘোরার আনন্দ, নতুন নতুন জায়গা দেখার কৌতূহল আর প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা তৈরি হওয়ার শুরু। এখনো মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করলে সেই ঢেউয়ের শব্দ শুনতে পাই, আর সূর্যোদয়ের সেই সোনালি আলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
এই স্মৃতি কখনোই ভুলবো না।
লেখক: রিশাদ (বয়স ১১)
ইউটিউব: Kuhudak

