আপনি যদি পাহাড়ে ঘুড়তে যাওয়ার পরিকল্পনা করে থাকেন তবে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস সাথে করে নিয়ে যেতে পারেন। পাহাড়ি এলাকা সাধারণত দুর্গম ও চ্যালেঞ্জিং হয়। তাই সেখানে যেকোনো ধরনের বিপত্তি এড়াতে আগে থেকেই সঠিক প্রস্তুতি নেয়া উচিত।
এই পোস্টে, আমরা পাহাড়ে ঘুরতে গেলে যেসব জিনিস সাথে রাখা প্রয়োজন তার তালিকা তুলে ধরব। চলুন শুরু করা যাক…
হয়ত আপনার কাছে এসব জিনিস অতিরিক্ত বোঝা মনে হতে পারে। অযথা ব্যাগ ভারী করার থেকে কিছুটা হাল্কা ব্যাগ নেয়া উচিত বলে মনে করে ফেলে যেতে পারেন এসব দরকারি জিনিসপত্র। বিশাল বড় কোন অভিযান অথবা কিছুদিনের পাহাড় ট্রেকিং যাই হোক না কেন, আপনার ফেলে যাওয়া প্রয়োজনীয় জিনিসটির মূল্য ঠিক তখনই বুঝবেন যখন দেখবেন যে, এই মূহূর্তে আপনার ঠিক ঐ জিনিসটিরই প্রয়োজন।
নিম্নে আমরা যে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো উল্লেখ করেছি তা আমাদের কল্পকাহিনী থেকে নয় বরং এইগুলো ১৯৩০ সালের দিকে কিছু প্রফেশনাল পর্বতারোহী প্রথম এই তালিকা প্রকাশ করেন। পরবর্তিতে আন্তির্জাতিক ব্লগ সাইটগুলি আধুনিক সময়ের সাথে সামাঞ্জাস্য রেখে কিছুটা পরিমার্জন করে প্রকাশিত করেছে।


চলুন, আর কথা না বাড়িয়ে প্রথমে আমরা জেনে নেই পাহাড় ভ্রমণ এর পূর্বে কি কি প্রস্তুতি নিতে হবে এবং কিভাবে নিজেকে এই জন্য উপযুক্ত করে তোলা যাবে। এরপর আমরা জানবো পাহাড়ে বেড়াতে গেলে কি কি নিতে হয়।
আরও: ১৫টি মোবাইল ভ্রমণ ফটোগ্রাফি টিপস
পাহাড়ে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরে যাওয়ার আগে পরিকল্পনা
প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিসাধারণ ঘোরাঘুরি ও ট্রেকিংয়ের এর জন্য আলাদাভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়। কারণ সেখানে সব সময় দ্রুত সাহায্য পাওয়া নাও যেতে পারে। এছাড়া ক্রমাগত উপরের দিতে উঠা বা নামার জন্য মানসিক ও শারীরিক দৃঢ়তা অর্জন করতে হবে।
শারীরিক প্রস্তুতি
পাহাড় বা দীর্ঘ ভ্রমণের আগে শারীরিকভাবে প্রস্তুত হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিক ফিটনেস আপনাকে যেকোনো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত রাখে। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক প্রস্তুতির ধাপ তুলে ধরা হলো।
শ্বাস-প্রশ্বাস উন্নত করা: হাঁটা, দৌড়ানো, সাইকেল চালানো, বা সাঁতার কাটা আপনার হার্ট এবং ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিটের কার্ডিও এক্সারসাইজ করুন, যা আপনাকে দীর্ঘ ভ্রমণের সময় শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে।
পেশি শক্তিশালীকরণ ব্যায়াম ভ্রমণের সময়, বিশেষ করে পাহাড়ি এলাকায় হাঁটার সময়, পায়ের ও কোমরের পেশির উপর চাপ পড়ে। পূর্বে থেকে নিয়মিত স্কোয়াট, পুশ আপ এবং লেগ প্রেসের মতো ব্যায়াম করলে আপনার পেশিগুলি শক্তিশালী হবে, যা পাহাড়ের দুর্গম লম্বা পথচলায় সহায়য়তা করবে।
নমনীয়তা বৃদ্ধি: শারীরিক নমনীয়তা ভ্রমণের সময় আপনার চলাচলকে সহজ করে তুলবে। নিয়মিত স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ করে শরীরের বিভিন্ন অংশের নমনীয়তা বৃদ্ধি করতে পারেন।
পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও পুনরুদ্ধার: শারীরিক প্রস্তুতির পাশাপাশি পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম হলে আপনার শরীর যেকোন পরিশ্রমের জন্য প্রস্তুত থাকবে।
মানসিকভাবে প্রস্তুতি
পাহাড়ে যাবার আগে থেকেই আপনার লক্ষ্য নির্ধারণ করুন এবং সেই অনুযায়ী নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করুন। আতঙ্ক বা হতাশা এড়াতে স্বতন্ত্র ও শান্ত মনোভাব বজায় রেখে নিজেকে ইতিবাচক রাখার চেষ্টা করুন।
পাহাড়ে চড়ার সময় যেসব জিনিস সাথে রাখা প্রয়োজন
পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার জন্য বেশির ভাগ সময় হাইকিং করতে হয়, হয়ত, কিছু ক্ষেত্রে যানবাহনে চড়ে গন্তব্যে পৌঁছান সম্ভব হয়। যাই হোক উভয় ক্ষেত্রেই হাতের কাছে দরকারি কোনো জিনিস কিনতে পাওয়ার সম্ভবনা কম আর বিপদে-আপদে অন্য কারোর সাহায্য পাবারও সম্ভাবনা নেই।
তাই ব্যাগ প্যাকিং করার সময় প্রয়োজনীয় জিনিস বহন করা উচিৎ। খুব বেশি কিছু নেওয়া যেমনসমস্যায় এবার প্রয়জনের কম হলেও সমস্যায় পড়তে পারেন।
পোর্টেবল টেন্ট বা ত্রিপল
পাহাড়ি এলাকায় হঠাৎ করে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটতে পারে, যা ভ্রমণের জন্য বিপদ সৃষ্টি করতে পারে। এমন পরিস্থিতি প্রায়শই দেখার কারন হলো, আমরা মূলত জানিনা যে, পাহাড়ি এলাকায় বেড়াতে গেলে কি কি নিতে হয়। এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইমার্জেন্সি শেল্টার বা আশ্রয়স্থল সঙ্গে নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত জরুরি।
পোর্টেবল টেন্ট বা ত্রিপল সঙ্গে রাখলে তা প্রয়োজনের সময় দ্রুত আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এছাড়া, ফোল্ডেবল স্লিপিং ব্যাগ বা ম্যাটও সঙ্গে রাখা উচিত, যা রাতের বেলা ঠান্ডা থেকে সুরক্ষা দেবে। ইমার্জেন্সি শেল্টারের ক্ষেত্রে, হালকা ওজনের এবং সহজে বহনযোগ্য সামগ্রী নেয়া উচিত, যাতে আপনার ব্যাগের ওজন বেশি না হয়।
হাইকিং উপযোগী পোশাক ও জুতা
পাহাড়ে ভ্রমণের জন্য সঠিক পোশাক ও জুতা বেছে নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পোশাক হিসেবে হালকা এবং সহজে শুকানো যায় এমন কাপড় পরা উচিত, যা শরীরের ঘাম শুষে নেবে এবং শরীরকে ঠান্ডা থেকে রক্ষা করবে। আরামদায়ক এবং ভাল মানের ট্রেকিং জুতা আপনার পায়ে সাপোর্ট প্রদান করবে এবং পিচ্ছিল বা পাথুরে পথে হাঁটার সময় পিছলে পরা থেকে নিরাপত্তা দিবে।
ত্বক ও চোখের প্রোটেকশন ব্যবস্থা
পাহাড়ে উচ্চতায় সূর্যের রশ্মি তীব্র হতে পারে, যা ত্বক ও চোখের জন্য ক্ষতিকারক। এইজন্য সান প্রোটেকশন হিসেবে সানস্ক্রিন, সানগ্লাস এবং হ্যাট ব্যবহার করা জরুরি। সানস্ক্রিন অবশ্যই উচ্চ SPF যুক্ত হওয়া উচিত, যা দীর্ঘ সময় ধরে ত্বককে সুরক্ষা দিবে। এছাড়াও আপনার সানগ্লাস UV প্রোটেকশন সম্বলিত হলে আরও ভাল হয়, কারণ এটি চোখকে ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রক্ষা করবে।
ইনসুলেশন এন্ড রেইন প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট (আবহাওয়া অনুযায়ী)
পাহাড়ি এলাকায় তাপমাত্রা দ্রুত পরিবর্তিত হতে পারে, বিশেষ করে রাতে বা উচ্চতায়। ইনস্যুলেশন ব্যবস্থা যেমন জ্যাকেট, উইন্ড চিটার, বা উলযুক্ত পোশাক সঙ্গে রাখা উচিত, যা শরীরকে গরম রাখবে।
বৃষ্টি হলে ভিজে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাই রেইনকোট বা রেইন প্যান্টের মতো বৃষ্টিরোধক পোশাক সঙ্গে রাখা জরুরি। এমন সামগ্রী বাছাই করুন যা হালকা এবং বহনযোগ্য এবং প্রয়োজনের সময় সহজেই ব্যবহার করা যায়।
প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম
ভ্রমণের সময় ছোটখাটো দুর্ঘটনা বা আঘাত হতে পারে, তাই প্রাথমিক চিকিৎসার দরকারি জিনিসপত্র সঙ্গে রাখা আবশ্যক। ব্যান্ডেজ, অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম, কটন, এবং পেইনকিলার সঙ্গে রাখা উচিত। এছাড়াও, আকস্মিক কোনো অসুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ যেমনঃ জ্বর-সর্দির প্রাথমিক ওষু্ধ, কফ সিরাপ ও গ্যাসের ওষুধ সঙ্গে রাখতে পারেন।
কোনও বিশেষ ধরনের এলার্জির জন্য অ্যান্টি-হিস্টামিন ওষুধও রাখা যেতে পারে। এসব প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম ছোট প্যাকেটে রাখতে পারেন যেমন, ব্যান্ডেজ, ডিসইনফেক্শন মলম ইত্যাদি। এগুলো সহজেই ব্যাগে রেখে প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়। এই ধরনের প্রস্তুতি আপনাকে জরুরি পরিস্থিতিতে প্রাথমিক সুরক্ষা দিতে সাহায্য করবে এবং বড় আঘাতের ঝুঁকি কমাবে।
অতিরিক্ত খাবার
পাহাড়ে ভ্রমণের সময় শারীরিক পরিশ্রম বেশি হয়, তাই শরীরের শক্তি বজায় রাখতে অতিরিক্ত খাবার সঙ্গে রাখা অত্যন্ত জরুরি। ভ্রমণের সময় পুষ্টিকর এবং সহজে বহনযোগ্য খাবার বেছে নেওয়া উচিত। নিচে কিছু উপযুক্ত খাবারের ধরন উল্লেখ করা হলো।
শুকনো খাবার: শুকনো খাবার, যেমন ট্রেইল মিক্স, গ্র্যানোলা বার, এবং চকলেট, ভ্রমণের সময় সহজে বহনযোগ্য এবং পুষ্টি সমৃদ্ধ বিকল্প হিসেবে কাজ করে। এগুলির মধ্যে উচ্চমাত্রার প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, এবং ফ্যাট থাকে।
প্রোটিন বার এবং এনার্জি বার: প্রোটিন বার বা এনার্জি বার সঙ্গে রাখা ভাল, কারণ এগুলি ছোট এবং হালকা, অথচ পুষ্টিকর। দীর্ঘ সময় হাঁটার পরে দ্রুত শক্তি ফিরে পেতে এগুলি খুবই কাজে দিবে।
শুকনো ফল: ফলের শুকনো টুকরো, যেমন কিশমিশ, খেজুর, বা ড্রাইড আপেল, দ্রুত শক্তি এবং প্রয়োজনীয় ভিটামিন সরবরাহ করতে পারে। এগুলি হালকা এবং ব্যাগে সহজেই বহন করা যায়।
এসকল খাবার প্যাক করার সময় হালকা এবং বহনযোগ্য ব্যাগ বাছাই করুন। খাবারগুলিকে ছোট প্যাকেটে ভাগ করে নিতে পারেন, যাতে প্রয়োজনমত সহজে বের করা যায়। এক্ষেত্রে প্লাস্টিকের জিপলক ব্যাগ ব্যবহার করা যেতে পারে।
খাবার পানি
যেকোনো ভ্রমণে পর্যাপ্ত পানি পান করা উচিত, বিশেষত পাহাড়ি এলাকায় যেখানে শারীরিক পরিশ্রম বেশি থাকে। এসব অঞ্চলে খাবার পানির সরবারহও থাকে না। তাই যথেষ্ট পরিমাণে পানি সঙ্গে রাখা উচিত। যদি সম্ভব হয়, পানি বিশুদ্ধ করার ফিল্টার বা ট্যাবলেটও সঙ্গে রাখুন, যাতে প্রয়োজন হলে পাহাড়ি ঝর্ণা বা নদীর পানি পরিশুদ্ধ করে পান করা যায়।
এছাড়াও আপনি ইলেক্ট্রোলাইট পানীয়ও সঙ্গে রাখতে পারেন। এটি আপনার শরীরের পানি এবং লবণ কমে গেলে তা পুনরায় পূরণ করতে সাহায্য করবে। এক্ষেত্রে সহজে বহনযোগ্য পানীয় বোতল ব্যবহার করা যেতে পারে, যা আপনাকে যাত্রার সময় বারবার না থেমেই পান করার সুযোগ দিবে।
—
পাহাড়ে ভ্রমণের সময় প্রকৃতির সাথে ঘনিষ্ঠতা আমাদের মনকে প্রশান্তি দেয়। সেই অভিজ্ঞতাকে আরও আনন্দদায়ক করার জন্য প্রয়োজন সঠিক প্রস্তুতি। উপযুক্ত পোশাক, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, পর্যাপ্ত খাবার, পানীয়, ওষুধপত্র, এবং নিরাপত্তা সরঞ্জামসহ আরও কিছু বিষয় মাথায় রেখে চললে ভ্রমণ আরও নিরাপদ এবং আরামদায়ক হবে। তাই পাহাড়ে ঘুরতে গেলে যেসব জিনিস সাথে রাখা প্রয়োজন, সেসকল জিনিস ভ্রমণের পূর্বেই সংগ্রহ করে রাখুন।
ফেসবুক: কুহুডাক