বজ্রপাতের সময় ভ্রমণে নিরাপদ থাকার উপায় কি? ভ্রমণ জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা। পাহাড়ের চূড়া, সবুজ বন, নির্জন সমুদ্রতট বা ছোট্ট কোনো অচেনা গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে আমরা প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হই। কিন্তু প্রকৃতির এই অপরূপ রূপের আড়ালে কখনো কখনো লুকিয়ে থাকে ভয়ংকর বিপদও। বজ্রপাত (Thunderstorm) ঠিক তেমনই এক অপ্রত্যাশিত বিপদ, যা মুহূর্তের মধ্যে একটি আনন্দঘন ভ্রমণকে দুঃসহ করে তুলতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বজ্রপাতের কারণে অনেক মানুষ প্রাণ হারায় বা গুরুতরভাবে আহত হয়। বিশেষ করে যারা পাহাড়, খোলা মাঠ বা জলাশয়ের আশেপাশে ভ্রমণ করেন, তাদের বজ্রপাতের সময় সতর্ক থাকা অত্যন্ত জরুরি।
এই পোস্টে আমরা খোলামেলা ভাষায় আলোচনা করবো — বজ্রপাতের সময় ভ্রমণে কি করবেন, কি করবেন না এবং কিভাবে নিজেকে এবং ভ্রমণ সঙ্গীদের সুরক্ষিত রাখবেন। চলুন শুরু করা যাক…
আরও: মোটরসাইকেলে ভ্রমণের জন্য বাংলাদেশের চমৎকার ৫টি রোড
বজ্রপাত কিভাবে ঘটে
বজ্রপাত মূলত বৈদ্যুতিক চার্জের দ্রুত বিনিময়ের ফলাফল। যখন মেঘের মধ্যে অথবা মেঘ আর ভূমির মধ্যে বৈদ্যুতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়, তখন আকাশ বিদ্যুতের ঝলকানি দিয়ে ফেটে পড়ে। বজ্রের সেই গর্জন ও আলোর ঝলক একদিকে যেমন রোমাঞ্চকর মনে হয়, অন্যদিকে এটি প্রাণঘাতীও হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে কয়েক হাজার মানুষ বজ্রপাতে আহত বা নিহত হন। বাংলাদেশের মতো বর্ষাপ্রবণ দেশে বজ্রপাতের আশঙ্কা আরো বেশি। তাই ভ্রমণে বের হওয়ার আগে বজ্রপাত সম্পর্কে সচেতন হওয়া খুবই জরুরি।
ভ্রমণের সময় বজ্রপাতের ঝুঁকি কেন বেশি
ভ্রমণের সময় আমরা প্রায়শই খোলা মাঠ, উঁচু পাহাড়, সমুদ্রের তীর বা জলাশয়ের ধারে থাকি। এসব জায়গা বজ্রপাতের আঘাতের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। উঁচু স্থানে থাকার ফলে শরীর বজ্রের জন্য সহজ টার্গেট হয়ে ওঠে। তাছাড়া ভ্রমণে অনেক সময় আমরা ধাতব সরঞ্জাম ব্যবহার করি — ক্যামেরা, ত্রিপড, হাঁটার লাঠি — এগুলিও ঝুঁকি বাড়ায়। তাই একটু অসতর্কতা ভয়ংকর পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারে।
আরও: ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত জুতা কোথায় কোনটি পরবেন
বজ্রপাতের সময় কি করবেন
১. আবহাওয়ার খবর রাখুন
ভ্রমণে যাওয়ার আগে এবং চলার পথে আবহাওয়ার আপডেট নিয়মিত দেখুন। যদি বজ্রপাতের সম্ভাবনা থাকে, তাহলে প্রয়োজনে যাত্রা স্থগিত করুন বা রুট পরিবর্তন করুন। আজকাল মোবাইল অ্যাপে সহজেই লাইভ আবহাওয়া রিপোর্ট পাওয়া যায় — কাজে লাগান।
২. নিরাপদ আশ্রয় খুঁজুন
বজ্রপাত শুরু হলে দ্রুত আশেপাশে শক্ত পাকা কোনো ভবন বা গাড়ির ভেতর আশ্রয় নিন। যদি গাড়িতে উঠতে হয়, তবে জানালা ভালো করে বন্ধ রাখুন। তবে খেয়াল রাখবেন — খোলা ছাউনি, ছোট কুঁড়েঘর, বা পাতলা কাঠের ঘর কখনোই নিরাপদ নয়।
৩. উঁচু জায়গা এড়িয়ে চলুন
পাহাড়ের চূড়া, উঁচু টিলা, গাছের ডালপালা — এসব স্থান বজ্রপাতের সময় প্রাণঘাতী হতে পারে। খোলা জায়গায় থাকলে দ্রুত সম্ভব নিচু এলাকায় চলে যান।
৪. শরীর নিচু করুন
খোলা মাঠে বজ্রপাত শুরু হলে দাঁড়িয়ে থাকা বিপজ্জনক। দুই পা জোড়া করে বসুন, শরীর যতটা সম্ভব নিচু রাখুন এবং মাথা ঢেকে রাখার চেষ্টা করুন। কখনোই পুরোপুরি মাটিতে শুয়ে পড়বেন না।
৫. বৈদ্যুতিক ও ধাতব সামগ্রী এড়িয়ে চলুন
মোবাইল, ক্যামেরা, ছাতা, হাঁটার লাঠি — বজ্রপাতের সময় এগুলো শরীরের কাছে রাখা বিপজ্জনক। এগুলো শরীর থেকে দূরে সরিয়ে ফেলুন এবং নিজেও এগুলো থেকে দূরে থাকুন।
আরও: গরমে আরামদায়ক ভ্রমণের গুরুত্বপূর্ণ টিপস
৬. পানির কাছাকাছি যাবেন না
নদী, পুকুর, লেক বা সমুদ্রের পাশে থাকলে অবিলম্বে সরে আসুন। পানি বজ্রের জন্য চমৎকার পরিবাহী মাধ্যম। নৌকায় থাকলে দ্রুত তীরে ফিরে আসার চেষ্টা করুন।
৭. গ্রুপে দূরত্ব বজায় রাখুন
যদি একসাথে অনেকজন ভ্রমণ করেন, বজ্রপাতের সময় অন্তত ৩ মিটার দূরত্ব বজায় রাখুন। এতে একজনের ওপর বজ্রপাত হলেও অন্যরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না।
বজ্রপাতের সময় কি কি করবেন না
১. মোবাইলে কথা বলবেন না
বজ্রপাতের সময় বিশেষ করে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলা বিপজ্জনক হতে পারে। ফোন ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন এবং নিরাপদ আশ্রয় খুঁজুন।
২. গাছের নিচে আশ্রয় নেবেন না
অনেকেই ঝড় বা বজ্রপাত শুরু হলে গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ান। এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। একাকী বা বড় গাছ বজ্রের সরাসরি লক্ষ্যবস্তু হতে পারে।
৩. ধাতব বস্তু বহন করবেন না
ক্যাম্পিং সরঞ্জাম, ব্যাকপ্যাকের ধাতব ফ্রেম, ধাতব হাতলযুক্ত ছাতা — এসব বজ্রের জন্য আকর্ষণ তৈরি করতে পারে। তাই বজ্রপাতের সময় এগুলো ব্যবহার বা বহন থেকে বিরত থাকুন।
৪. পানিতে থাকবেন না
সাঁতার কাটছেন? কিংবা নৌকায় ঘুরছেন? বজ্রপাত শুরু হলে অবিলম্বে পানির ধারে বা পানির মধ্য থেকে উঠে আসুন। নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিন।
৫. একসাথে জটলা করবেন না
ভ্রমণসঙ্গীদের সঙ্গে খুব কাছে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। বজ্রপাত হলে অনেকের একসাথে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
আরও: ভ্রমণকালীন নিরাপত্তা টিপস
নিরাপদ থাকার আরও কিছু জরুরি টিপস
- হেডফোন খুলে ফেলুন: বজ্রপাতের সময় ইয়ারফোন বা হেডফোন ব্যবহার বন্ধ করুন।
- লাইটনিং সেফ জোন তৈরি করুন: গভীর জঙ্গলে ভ্রমণ করলে অস্থায়ীভাবে একটা এলাকা খুঁজে সেখানে মাথা নিচু করে নিরাপদ আশ্রয় নিন।
- ৩০/৩০ নিয়ম মনে রাখুন: বজ্রপাতের ঝলকানি দেখার ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে যদি বজ্রের শব্দ শুনতে পান, তবে বুঝবেন বজ্রপাত ১০ কিমি’র মধ্যেই হচ্ছে। বজ্রপাতের পর অন্তত ৩০ মিনিট অপেক্ষা করুন নিরাপদ আশ্রয়ে।
- সতর্ক সংকেত অনুসরণ করুন: কখনো কখনো বজ্রপাতের আগে বাতাসে ইলেকট্রিক্যাল অনুভূতি বা শরীরে চুলকানি অনুভব হতে পারে — এটি বজ্রপাতের পূর্বাভাস। সঙ্গে সঙ্গে নীচু হয়ে যান।
ভ্রমণ জীবনের অপার আনন্দের নাম, তবে প্রকৃতির সামনে আমাদের সতর্কতাই আমাদের বড় অস্ত্র। বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ অবহেলা করা উচিত নয়। বরং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে আমরা নিজেরা নিরাপদ থাকতে পারি এবং আমাদের ভ্রমণও সুন্দর ও স্মরণীয় হয়ে উঠতে পারে।
তাই মনে রাখুন, প্রকৃতির সৌন্দর্যের পাশাপাশি তার শক্তির প্রতিও সমান শ্রদ্ধাশীল থাকুন। সচেতন থাকুন, নিরাপদ থাকুন, আনন্দের সঙ্গে ভ্রমণ করুন।
ভ্রমণ হোক আনন্দময়, নিরাপদ ও সচেতনতার সঙ্গে!
আরও: ভ্রমণে নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ১০টি টিপস
ভ্রমণে নিরাপত্তা সম্পর্কিত ১০টি সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
বজ্রপাতের সময় ভ্রমণে বাইরে থাকলে কী করবো?
দ্রুত সম্ভব নিচু কোনো জায়গায় আশ্রয় নিন। পাকা ভবন বা গাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ুন। খোলা মাঠ, গাছের নিচ, পাহাড়ের চূড়া থেকে দূরে থাকুন এবং শরীর যতটা সম্ভব নিচু করে রাখুন।
গাছের নিচে দাঁড়ানো কি নিরাপদ?
না, গাছের নিচে দাঁড়ানো অত্যন্ত বিপজ্জনক। গাছ সাধারণত বজ্রপাতের প্রথম টার্গেট হয়। তাই গাছের নিচে আশ্রয় নেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
গাড়ির ভিতরে থাকলে কি বজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকব?
হ্যাঁ, যদি গাড়ির ছাদ ধাতব হয় (ক্যাবলেস গাড়ি), তবে জানালা বন্ধ করে বসে থাকলে আপনি তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। তবে খেয়াল রাখুন — গাড়িতে থাকা অবস্থায় ধাতব অংশ স্পর্শ করবেন না।
খোলা মাঠে বজ্রপাত শুরু হলে কিভাবে বসবো?
দুই পা একসঙ্গে জোড়া করে মাটিতে বসুন, শরীর নিচু করুন এবং মাথা দুহাতে ঢেকে রাখুন। মাটিতে পুরোপুরি শুয়ে পড়বেন না।
মোবাইল ফোন ব্যবহার করা কি বিপদজনক?
হ্যাঁ, বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গায় মোবাইল ফোন বা ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করা বিপদজনক হতে পারে। নিরাপদ জায়গায় পৌঁছানোর আগে ফোন ব্যবহারে বিরত থাকুন।
সমুদ্র বা নদীতে থাকলে কি করা উচিত?
দ্রুত সম্ভব পানির কাছ থেকে সরে যান। নৌকায় থাকলে তীরে ফিরে আসুন এবং নিরাপদ কোনো স্থানে আশ্রয় নিন।
বজ্রপাতের সম্ভাবনা আগে থেকেই কিভাবে বুঝবো?
আকাশে ঘন কালো মেঘ জমা হওয়া, বাতাসের আচমকা পরিবর্তন — এসব বজ্রপাতের পূর্বাভাস। এছাড়া মোবাইল অ্যাপ বা আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখে প্রস্তুত থাকা যায়।
ক্যাম্পিং টেন্টে থাকা কি নিরাপদ?
না, সাধারণ কাপড় বা প্লাস্টিকের টেন্ট বজ্রপাতের সময় কোনো সুরক্ষা দেয় না। দ্রুত পাকা ভবন বা গাড়ির মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নেওয়া উচিত।
বজ্রপাত থামার কতক্ষণ পর আবার বাইরে বের হওয়া নিরাপদ?
বজ্রপাত শেষ হওয়ার পরে কমপক্ষে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করা উচিত। তখনই বাইরে বের হওয়া নিরাপদ হবে, কারণ কখনো কখনো পরপর কয়েকটি বজ্রপাত হতে পারে।
ফেসবুক: কুহুডাক