আমার চোখে ঢাকা শহর দেখতে কেমন লেগেছে তাই বলব তোমাদের। আমি রাকিব। বয়স ১২। আমি এখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। আমাদের বাড়ি কুমিল্লায়। আগে কখনো ঢাকা যাওয়া হয়নি, শুধু বই আর টিভিতে দেখেছি- ঢাকা নাকি অনেক বড় শহর, লোকজনে ভরা, গাড়িতে ঠাসা আর আলোয় ঝলমল। আমি ভাবতাম, এত বড় শহরে গেলে আমি নিশ্চয়ই পথ হারিয়ে ফেলব। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ইচ্ছে ছিল খুব, একবার ঢাকায় যাই, শহরটা দেখি নিজে চোখে। কেমন লাগে।
এই ঈদের ছুটিতে আব্বু হঠাৎ বললেন, “রাকিব, চল এবার ঢাকায় যাওয়া যাক। একদিনের জন্য, কিন্তু অনেক কিছু ঘুরে দেখাবো।”
আমি তো খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম! মনে হচ্ছিল আমি যেন স্বপ্ন দেখছি। ব্যাগে জামা-কাপড় আর আমার প্রিয় নোটবুক নিয়ে তৈরি হয়ে গেলাম।
আমরা কুমিল্লা থেকে সকালবেলা বাসে উঠলাম। জানালার পাশে বসে চারপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে ভেবে যাচ্ছিলাম- আজ আমি সেই শহরে যাচ্ছি, যে শহরের নাম সবাই বলেই, “ঢাকা সবকিছুর শহর!”
আরও: নদীর পারে আমার প্রথম ক্যাম্পিং
প্রায় তিন ঘণ্টা পর যখন আমরা ঢাকার ভিতরে ঢুকলাম, আমি প্রথমেই যেটা খেয়াল করলাম, সেটা হলো গাড়ির ভিড়। সিগনাল, হর্ন, সিএনজি, বাস, প্রাইভেট কার, বাইক- সব যেন একসাথে চলছে। আর লোকজন! এত মানুষ আগে একসাথে কখনো দেখিনি। ফুটপাতে মানুষ হাঁটছে, কেউ মোবাইলে কথা বলছে, কেউ দৌড়াচ্ছে, কেউ জুস খাচ্ছে। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম, একেকজনের মুখে একেকরকম গল্প।
আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল জাতীয় জাদুঘর। শাহবাগে নেমে আব্বু আমার হাত ধরে নিয়ে গেলেন ভেতরে। আমি ভিতরে ঢুকেই হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। একেকটা গ্যালারিতে কত রকমের জিনিস! প্রাচীন মূর্তি, সুলতানি আমলের তলোয়ার, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, মাটির তৈরি খেলনা, পুরনো বই… আমার তো মনে হচ্ছিল আমি টাইম মেশিনে উঠে ইতিহাসের ভিতর ঢুকে গেছি।
একটা গ্যালারিতে বাংলাদেশের বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছবি টাঙানো ছিল। আব্বু দেখালেন বঙ্গবন্ধুর ছবি, আর বললেন, “এই মানুষটাই আমাদের স্বাধীনতার নেতা।” আমি নোটবুকে লিখে রাখলাম- “ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে আমি আমাদের ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখেছি।” হাটতে হাটতে আমার পা ব্যথা হয়ে গেলো। তাও ভালো লাগছিল।
এরপর আমরা গেলাম লালবাগ কেল্লা। ছোটবেলায় বইয়ে পড়েছি এই কেল্লা নিয়ে। এবার নিজের চোখে দেখলাম। বিশাল লাল ইটের দেওয়াল, সবুজ ঘাসে ঘেরা চারপাশ, আর এক প্রকার ইতিহাসের গন্ধ যেন বাতাসেই ভাসছে। আমি দৌড়ে দৌড়ে পুরো জায়গাটা ঘুরে দেখলাম। মনে হচ্ছিল আমি একজন মুঘল সেনাপতি, দুর্গ পাহারা দিচ্ছি।
একটা জায়গায় একটা ছোট্ট ফোয়ারা ছিল। আমি ওখানে গিয়ে বসলাম। আব্বু বললেন, “এই জায়গাটা আগে রাজকন্যারা ঘুরে বেড়াতেন।” আমি চোখ বন্ধ করে কল্পনা করলাম- এক রাজকন্যা সবুজ ঘাসের উপর হেঁটে যাচ্ছে, আর পাশে তার প্রহরীরা হাঁটছে। আমি যেন একটু ইতিহাস ছুঁয়ে ফেললাম।
এরপর দুপুরে আমরা নিউ মার্কেটের পাশে এক হোটেলে খেতে গেলাম। ভীষণ ভীড়, কিন্তু খাবারের গন্ধেই মন ভরে গেল। আমি বিরিয়ানি খেলাম আর লেবু-চা। হোটেলের পাশেই একটা ছোট দোকানে গেলাম, সেখান থেকে আমি একটা ছোট্ট ঢাকা শহরের কার্ড কিনলাম। কার্ডে জাতীয় সংসদ ভবনের ছবি ছিল। আমি সেটা আমার ডায়েরির মধ্যে রাখলাম।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল জাতীয় সংসদ ভবন। আমি শুধু ছবি দেখেছি আগে। এবার যখন সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, আমার চোখ আটকে গেল। বিশাল, গোলমতো গঠন, যেন ভবিষ্যতের কোনো বিল্ডিং। আব্বু বললেন, “এই ভবনটা লুই কানের ডিজাইন করা।”
আমি বললাম, “সে কে?”
আব্বু বললেন, “একজন বিখ্যাত স্থপতি। বিদেশি হলেও বাংলাদেশের জন্য এই ভবনটি উপহার দিয়েছেন।” আমি ভাবলাম, একজন বিদেশি যদি আমাদের দেশকে ভালোবেসে এমন কিছু করতে পারে, তাহলে আমরা কেন করব না?
শেষ বিকেলে আমরা গেলাম হাতিরঝিল। সূর্য ডোবার সময় চারপাশটা লাল হয়ে গেল। পানির উপর ব্রিজ, চারপাশে আলো, আর অনেক মানুষ হাঁটছে। আমি আব্বুর হাত ধরে হাঁটছিলাম আর ভাবছিলাম— “এই ঢাকা শহর শুধু গাড়ি আর কোলাহলের শহর না, এখানে মনের জায়গাও আছে।”
একটা জায়গায় কিছু ছেলে আকাশে ফানুস ওড়াচ্ছিল। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। ফানুসটা ওপরে উঠে গেল আর ধীরে ধীরে আলোর বিন্দু হয়ে গেল। আব্বু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমারও তো অনেক স্বপ্ন আছে, তাই না?” আমি মাথা নেড়ে বললাম, “হ্যাঁ, আমি একদিন এই শহরে পড়তে আসব। বড় হয়ে এখানে কাজ করব, কিছু বানাবো-যা মানুষ মনে রাখবে।”
রাত হয়ে এলে আমরা আবার বাসে উঠে কুমিল্লার পথে রওনা হলাম। জানালার পাশে বসে আমি আকাশের তারা দেখছিলাম। আজকের দিনটা ছিল আমার জীবনের সেরা দিনগুলোর একটি। শুধু জায়গা ঘোরা না, আমি যেন নিজেকে একটু নতুন করে চিনলাম।
ঢাকা শহর আমাকে শিখিয়েছে-
👉 বিশালতা মানেই ভয় না, বরং সম্ভাবনা।
👉 কোলাহলেও সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে।
👉 ইতিহাসের মাঝেই ভবিষ্যতের পথ খুঁজে পাওয়া যায়।
আমি ঠিক করেছি, আজ রাতেই আমার নোটবুকে এই পুরো দিনটার গল্প লিখে রাখবো। কারণ আমি জানি, অনেক বছর পর হয়তো আমি ভুলে যাব ছোট ছোট ঘটনা, কিন্তু এই অনুভবটা আমি কোনোদিন ভুলবো না।
লেখক: রাকিব (বয়স ১২)
আরও গল্প: আমি প্রথমবার সমুদ্র দেখলাম

