জাফলং (Jaflong) বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলায় ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষা খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে এই পর্যটনস্থল।
আজকের পোস্টে আমরা সিলেটের জাফলং যাওয়ার উপায়, থাকা খাওয়ার খরচ ও টিপস নিয়ে বিস্তারিত থাকছে। চলুন শুরু করা যাক…

আরও: পান্থুমাই ঝর্ণা
জাফলং ভ্রমণ
| ভ্রমণ স্থান | জাফলং |
| ধরন | পাথর কোয়ারি স্থান, দর্শনীয় স্থান |
| অবস্থান | গোয়াইনঘাট, সিলেট |
| সিলেট শহর থেকে দূরত্ব | প্রায় ৫০ কিলোমিটার |
| ঢাকা থেকে দূরত্ব | প্রায় ৩০০ কিলোমিটার |
| ড্রোন উড়ানো যাবে | অনুমতি সাপেক্ষে |
| জনপ্রতি প্রবেশ ফি | ফ্রি |
| খোলা থাকে | সবসময় |
| ভ্রমণের উপযুক্ত সময় | বর্ষায় |
সিলেট শহর থেকে জাফলং এর দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। এখানে মূলত পাথর উত্তলন করা হয়। পাহাড় আর নদীর অপূর্ব সম্মিলন বলে এই এলাকা বাংলাদেশের ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে অন্যতম একটি পর্যটনস্থল হিসেবে পরিচিতি রয়েছে।
আরও: বিছনাকান্দি
জাফলংয়ে কি রয়েছে
প্রকৃতির কন্যা হিসাবে পরিচিত জাফলং সিলেট জেলার দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে অন্যতম। ভ্রমণে এখানে আপনি বাংলাদেশ সীমান্তে দাঁড়ালে ভারত সীমান্ত অভ্যন্তরে থাকা উঁচু উঁচু পাহাড় দেখতে পাবেন।
এসব পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণার পানি একেবারে স্বচ্ছ যা পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে কাজ করে। এছাড়া ভ্রমণে আরও ভারতের ডাউকি বন্দরের ঝুলন্ত সেতুও দেখতে পাবেন।

এখানে রয়েছে সর্পিলাকারে বয়ে চলা ডাওকি নদী। এই নদীর পানিও একেবারে স্বচ্ছ। মৌসুমী বায়ুপ্রবাহের ফলে ভারত সীমান্তে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। যার ফলে নদীর স্রোত বেড়ে গিয়ে নদী ফিরে পায় তার প্রাণ, আর হয়ে ওঠে আরও মনোরম, যা দেখতে অপরূপ লাগে।
আপনি যদি পহেলা বৈশাখে এখানে ভ্রমণে আসেন তাহলে বাংলা নববর্ষকে ঘিরে আয়োজন করা বৈশাখী মেলা দেখতে পাবেন। আর এখানে বৈশাখী মেলাকে ঘিরে উৎসবে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো এলাকা।

জাফলং ভ্রমণের আদর্শ সময় বর্ষাকাল। তবে, শীতকালেও এখানে আলাদা সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। বর্ষাকালে রয়েছে বৃষ্টিস্নাত গাছ-গাছালি আর খরস্রোতা নদী দেখতে আসাধারন লাগে। তাছাড়া পাহাড়ের মাথায় মেঘের দৃশ্যও আপনার ভ্রমণ কে আরও মনোরম করে তুলবে।
আরও: জাফলং ভ্রমণ
ইতিহাস
ঐতিহাসিক তথ্য মতে জানা যায় যে, হাজার বছর ধরে জাফলং ছিল খাসিয়া জৈন্তা-রাজার অধীনে থাকা এক নির্জন বনভূমি। এখানে বন-জঙ্গলে ভরপুর ছিল। কিন্তু ১৯৫৪ সালের দিকে জমিদারী প্রথার বিলুপ্ত হওয়ার পর খাসিয়া-জৈন্তা রাজ্যের অবসান ঘটলেও বেশ কয়েক বছর জাফলংয়ের সম্পূর্ণ এলাকা পতিত পড়েছিল।

পরবর্তিতে পাথর ব্যবসায়ীরা পাথরের সন্ধানে বিভিন্ন এলাকা থেকে নৌপথে জাফলং আসতে শুরু করে। যেহেতু এখানে প্রচুর পাথর রয়েছে তাই, পাথর ব্যবসার প্রসার ঘটতে থাকলে এই ব্যবসাকে কেন্দ্র করে একসময় এখানে গড়ে ওঠে নতুন জনবসতি।
আরও: শ্রীমঙ্গল
পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য
সিলেট জেলার এই দর্শনীয় স্থানে নারিকেল আর সুপারির গাছকে কেন্দ্র করে বাস করে প্রচুর বাদুড়। এছাড়া আপনি জাফলং বাজার কিংবা জমিদার বাড়িতে বাদুড়ের দেখা পাবেন। তবে সেটা আগের মত নয়। পূর্বে এখানে প্রচুর বাদুড় দেখা যেত। মানুষের বসবাস, কিংবা অবাধ বৃক্ষনিধনের ফলে বাদুড় গুলো জৈয়ন্তিয়া আর গোয়াইনঘাটের বেঁচে থাকা বনাঞ্চলে, কিংবা প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে যাচ্ছে।
এখানে সিলেটে সীমান্তবর্তী অপর পাশে রয়েছে ভারতের ডাউকি অঞ্চল। মূলত বলা যায় যে, পিয়াইন নদীর অববাহিকায় জাফলং রয়েছে। বাংলাদেশে ৪ ধরনের কঠিন শিলা পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে ভোলাগঞ্জ-জাফলংয়ে পাওয়া যায় কঠিন শিলার নুড়ি।

এছাড়া বর্ষার সময় ভারতীয় সীমান্তবর্তী শিলং মালভূমির পাহাড়গুলোতে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে ফলে, ঐসব পাহাড় থেকে ডাউকি নদীর প্রবল স্রোত বয়ে আনে বড় বড় গণ্ডশিলাও। মূলত এই কারণে সিলেট জেলার জাফলং -এর নদীতে প্রচুর পরিমাণে পাথর পাওয়া যায়। এছাড়া পনি এখানে সাদামাটি বা চীনামাটিও দেখতে পাবেন।

এখানে উপজাতিদের পাশাপাশি সাধারণ বাঙালিরা বসবাস করে থাকেন। বল্লা, সংগ্রামপুঞ্জি, নকশিয়াপুঞ্জি, লামাপুঞ্জি ও প্রতাপপুর জুড়ে রয়েছে ৫টি খাসিয়াপুঞ্জী যা আদমশুমারী অনুযায়ী এখানে ১,৯৫৩ জন খাসিয়া উপজাতি বাস করে থাকেন।
আরও: গ্রীনল্যান্ড পার্ক
কিভাবে যাবেন
বাংলাদেশের যে কোন স্থান থেকে আপনি এখানে ভ্রমণে আসতে পারেন। রাজধানী ঢাকা থেকে আপনি বাস, ট্রেন ও বিমানে করে ভ্রমণে যেতে পারবেন।
ঢাকা থেকে বাসে সিলেট
রাজধানী ঢাকা থেকে সিলেট যেতে ঢাকার ফকিরাপুল, গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে এসি ও নন-এসির গ্রীন লাইন, সৌদিয়া, ইউনিক, এস আলম, শ্যামলি, এনা ও লন্ডন এক্সপ্রেস বাস করে যেতে পারেন। বাসে সিলেট যেতে সময় লাগে প্রায় ৬ ঘন্টা থেকে ৮ ঘন্টার মত।
ভাড়া: বাসে যেতে জনপ্রতি ভাড়া নিতে পারে ৬৫০ টাকা থেকে ২,০০০ টাকা।
ঢাকা থেকে ট্রেনে সিলেট
রাজধানী ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশান থেকে কিংবা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশান থেকে উপবন, জয়ন্তিকা, পারাবত অথবা কালনী এক্সপ্রেসে করে সিলেট যেতে পারবেন। ট্রেনে সিলেট যেতে সময় লাগতে পারে প্রায় ৬ ঘন্টা থেকে ৭ ঘন্টার মত।
ভাড়া: ট্রেনে শ্রেণী ভেদে ভাড়া নিতে পারে ৩৫০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা।
ঢাকা থেকে বিমানে সিলেট
আপনি যদি ঢাকা থেকে দ্রুত সিলেট যেতে চান তাহলে আপনাকে বিমানে বা প্লেনে যেতে হবে। ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, নভোএয়ার, ইউএস বাংলা, এয়ার এস্ট্রা সহ বেশ কিছু বিমান সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাই করে থাকে।
আপনি যেকোনো ডোমেস্টিক এবং আন্তর্জাতিক গন্তব্যে সস্তায় বিমানের টিকিট নিতে পারেন কুহুডাক এয়ার থেকে।
ভাড়া: ঢাকা থেকে সিলেট বিমান ভাড়া সময়, ক্লাস এবং প্লেন ভেদে বিভিন্ন হতে পারে। তবে, বিমানের টিকিট মূল্য ৩,৫০০ টাকা থেকে ১০,০০০ টাকা হতে পারে।
চট্রগ্রাম থেকে সিলেট
আপনি চট্রগ্রাম থেকে সিলেট ভ্রমণে যেতে পারেন। চট্রগ্রাম থেকে গ্রীনলাইন, এনা, সৌদিয়া ও লন্ডন এক্সপ্রেস সহ বেশ কিছু এসি ও নন-এসি পরিবহন সিলেট গিয়ে থাকে।
ভাড়া: চট্রগ্রাম থেকে সিলেট বাস ভাড়া ৮০০ টাকা ১৮০০ টাকা নিতে পারে।
আপনি চাইলে চট্টগ্রাম থেকে সিলেট ট্রেনে যেতে পারবেন। ট্রেন পাহাড়িকা এবং উদয়ন এক্সপ্রেস সিলেট গিয়ে থাকে।
ভাড়া: শ্রেণী ভেদে ট্রেনের ভাড়া ৪৫০ টাকা থেকে ১৬০০ টাকা নিতে পারে।
বি:দ্র: চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমানে ঢাকা হয়ে সিলেট যাবার সুযোগ রয়েছে।
সিলেট থেকে জাফলং
বাস, ট্রেন কিংবা বিমানে করে সিলেট আসার পর সিলেট থেকে কিভাবে জাফলং যাওয়া যাবে তার জানব। বিস্তারিত ভালো করে পড়ে বুঝার চেষ্টা করবেন। না বুঝলে বার বার পড়বেন।
সিলেট শহর থেকে জাফলংয়ের দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। আপনি সিলেট থেকে বাস, CNG, লেগুনা কিংবা মাইক্রোবাসে করে সরাসরি জাফলং যেতে পারবেন। যেতে সময় লাগবে প্রায় ২ ঘন্টা।
সিলেট কদমতলী বাস টার্মিনাল থেকে লোকাল বাসে জনপ্রতি ৭০ টাকা ভাড়া দিয়ে যেতে পারবেন আর বিরতীহীন বাসে যেতে ভাড়া লাগবে ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকা। চাইলে সিলেট শহরের সোবহানীঘাট থেকেও বাসে উঠতে পারবেন। বাস ছাড়াও জাফলং যাওয়ার লোকাল লেগুনা সার্ভিস রয়েছে এখানে।
আপনি যদি রিজার্ভ গাড়িতে যেতে চান তাহলে বন্দরবাজার শিশুপার্কের সামনে থেকে CNG, লেগুনা বা মাইক্রোবাস পাবেন। এছাড়া সিলেটের প্রায় সব স্থান থেকে রিজার্ভ যাওয়ার গাড়ি পাবেন। সিএনজিতে সর্বোচ্চ ৫ জন যেতে পারবেন আর লেগুনাতে গেলে ১০ জন এবং মাইক্রোবাসের আসন অনুযায়ী বসে যেতে পারবেন।
ভাড়া: জাফলং যাওয়া এবং আসা সহ সারাদিনের জন্যে CNG ভাড়া নিতে পারে ১২০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা (অবশ্যই দরদাম করে নিবেন), লেগুনায় যেতে নিতে পারে ২০০০ টাকা থেকে ২৫০০ টাকা এবং মাইক্রোবাস রিজার্ভ নিলে ভাড়া নিতে পারে ৩০০০ থেকে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত।
বি:দ্র: আপনারা যদি কয়েকজন একসাথে ভ্রমণে যান তাহলে গাড়ি রিজার্ভ নিলে ভালো হবে। যাওয়ার পথে অন্যান্য দর্শনীয় স্থান সহজে ঘুরে দেখতে পারবেন। আর অবশ্যই গাড়ি রিজার্ভ করার আগে কি কি দেখতে চান তা জানিয়ে দরদাম করে নিবেন।
যদি পিকনিক কিংবা পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসেন তাহলে প্রাইভেট কার নিয়ে সরাসরি জাফলং পর্যন্ত যেতে পারবেন। এখানের রাস্তা বেশ ভালো। তবে মনে রাখবেন যে, মামার বাজার না গিয়ে গুচ্ছগ্রাম বিজিবি ক্যাম্প হয়ে জাফলং জিরো পয়েন্ট যাওয়ার রাস্তাটি বেশ জনপ্রিয়।
আরও: হাতিরঝিল
কোথায় খাবেন
সিলেট জেলার বিখ্যাত খাবার হচ্ছে চা, কমলালেবু, সাতকড়ার আচার। তবে, ভ্রমণে গেলে সাথে অবশ্যই খাবার পানি রাখবেন। এছাড়া জাফলংয়ে খাওয়ার জন্য রেস্টুরেন্টের মধ্যে জাফলং ভিউ রেস্টুরেন্ট, সীমান্ত ভিউ রেস্টুরেন্ট এবং জাফলং পর্যটক রেস্টুরেন্ট ইত্যাদিতে খেতে পারেন।
আর যদি সিলেট শহরে খেতে চান তাহলে, জিন্দাবাজার এলাকায় অবস্থিত পানসী, পাঁচ ভাই কিংবা পালকি রেস্টুরেন্টের খেতে পারেন। এখানের খাবার অসাধারণ এবং কম মূল্যে পছন্দমত খাবার খেতে পারবেন। এই রেস্টুরেন্টগুলোতে অনেক রকম ভর্তা, খিচুড়ি এবং মাংসের পদ রয়েছে।
আরও: বাংলাদেশের ৬৪ জেলার বিখ্যাত খাবারের তালিকা
কোথায় থাকবেন
জাফলং ভ্রমণে গিয়ে থাকার জন্য আপনাকে সিলেট শহরে ফিরে আসতে হবে। আর সিলেট শহরে এসে থাকাটাই উত্তম। আর যদি জাফলং যদি থাকতেই হয় তাহলে, জিরো পয়েন্টের কাছে জাফলং গ্রিন রিসোর্ট অথবা মামার বাজার এলাকায় জাফলং ইন হোটেল ও হোটেল প্যারিস সহ আরও বেশ কিছু রেস্ট হাউজ পাবেন।
সিলেট শহরের বেশিরভাগ হোটেলগুলো হযরত শাহজালাল (রঃ) মাজারের আশেপাশকে ঘিরে রয়েছে। এছাড়া, দরগা গেট হতে আম্বরখানা, তালতলা, লামাবাজার, কদমতলী পর্যন্ত বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল পাবেন।
সতর্কতা ও ভ্রমণ টিপস
জাফলং নিরাপদে ভ্রমণের জন্য নিচে কিছু ভ্রমণ টিপস ও সতর্কতা দেয়া হল। আশাকরি এই টিপস গুলো আপনার ভ্রমণে অনেক কাজে দিবে।
- ভ্রমণের পূর্বে আপনার প্রয়োজনীয় জামাকাপড়, ক্যামেরা, চার্জার, ব্রাশ ইত্যাদি ব্যাগে ঘুছিয়ে নিন।
- একা ভ্রমণের চেয়ে গ্রুপ করে গেলে খরচ কম হবে।
- পানিতে নামার জন্য বা গোসল করার জন্য সাথে অতিরিক্ত কাপড় নিয়ে নিন।
- কিছু কিনতে বা খেতে চাইলে দরদাম করে নিন।
- পানিতে নামার সময় সাথে থাকে ক্যামেরা, ব্যাগ, জামাকাপড় ইত্যাদি নিরাপদ স্থানে রাখুন।
- বর্ডারের খুব কাছে যাবেন না। যেহেতু জাফলং সীমান্তবর্তী এলাকা, তাই সীমান্ত এলাকার নির্দেশনা মেনে চলুন।
- পানিতে নামার সময় সতর্ক থাকুন, পাথর উত্তোলনের ফলে অনেক যায়গা বেশ গভীর।
- অতিরিক্ত ছবি তোলা এবং ভিডিও করতে গিয়ে আসল সৌন্দর্য্য দেখতে ভুলবেন না।
ইউটিউব: Kuhudak



Add your first comment to this post
You must be logged in to post a comment.