সুখিয়া ভ্যালি (Sukhiya Valley) বাংলাদেশের চট্রগ্রাম বিভাগের দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্য জেলা বান্দরবানের লামা উপজেলার মাতামুহুরি নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা এক অপরূপ পর্যটন কেন্দ্র বা দর্শনীয় পর্যটন স্পট, যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৬০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত রয়েছে। এটির চারপাশ ঘিরে রয়েছে সবুজ পাহাড় আর শান্ত নদীর সৌন্দর্য যা পর্যটক কিংবা প্রকৃতি প্রেমিদের আকৃষ্ট করে থাকে।
চলুন বান্দরবান জেলার সুখিয়া ভ্যালি ভ্রমণের বিস্তারিত তথ্য জানা যাক…
আরও: মেঘলা পর্যটন কেন্দ্র
ভ্যালিতে যা যা দেখবেন
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৬০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এই সুখিয়া ভ্যালিতে ভ্রমণে গেলে আপনি চারপাশে সবুজ পাহাড় ও মাতামুহুরি নদীর দৃশ্য ও বিকেলের সূর্যাস্ত দেখার পাশাপাশি পাহাড়ের চুড়ায় ওয়াচ টাওয়ার দেখতে পাবেন। এই ওয়াচ টাওয়ার থেকে আপনি মাতামুহুরী নদী ও এর দুই পাশে সুখিয়া ও দুখিয়া পাহাড় দেখতে পাবেন। এখান থেকে চারপাশের প্রকৃতি অসাধারণ লাগে।

ওয়াচ টাওয়ারের ঠিক পাশেই রয়েছে জুম ঘর ও ক্যাম্পিং করার যায়গা। যারা ক্যাম্পিং করতে চান তাদের জন্য এই স্থানটি দারুণ আদর্শ। এছাড়াও আপনি যদি এডভেঞ্চার পছন্দ করেন তাহলে আপনার জন্য এখানে রয়েছে হিল হাইকিং ও ট্র্যাকিং করার দারুণ ব্যবস্থা।
আপনি একা কিংবা ফ্যামিলি কিংবা দলগত ভাবে ভ্রমণে গেলে মাতামুহুরী নদী থেকে নৌকা ভাড়া নিয়ে ঘুরে দেখতে ভুলবেন না। নৌকা আপনি আশেপাশের সুন্দর বেশ কিছু স্পট যেমন, মিনঝিরি পাড়া, সাদা পাহাড়, সুখিয়া ও দুখিয়া পাহাড়সহ আরও কয়েকটি আকর্ষণীয় স্পট ঘুরে দেখতে পারবেন।
যারা ইতিমধ্যে মিরিঞ্জা ভ্যালি ভ্রমণে গিয়েছেন তারা জানেন যে লামার জনপ্রিয় মিরিঞ্জা ভ্যালির মত এটিও একটি ভ্যালি। তবে এই ভ্যালিতে থাকার মত খুব বেশি রিসোর্ট বা কটেজ নেই বললেই চলে।
আরও ক্লিয়ার ভাবে বললে, এই স্থানটি কাদের ভ্রমণের জন্য আদর্শ? তাহলে আমি বলব যে, যেসব পর্যটকদের মেঘ দেখার পাশাপাশি মাতামুহুরী নদীর দৃশ্য দেখার ইচ্ছে আছে তাদের জন্য এই সুখিয়া ভ্যালি উপযুক্ত স্থান।

আরও: সাঙ্গু নদী
পয়েন্ট আকারে ভ্যালিতে কি কি দেখবেন
এবার চলুন সংক্ষেপে পয়েন্ট আকারে সুখিয়া ভ্যালিতে কি কি দেখবেন তা জানি।
- সবুজ পাহাড় ও মাতামুহুরি নদীর দৃশ্য।
- মাতামুহুরি নদীর দুই পাশে অবস্থিত সুখিয়া ও দুখিয়া পাহাড়ের মিলনমঞ্চ।
- জুম ঘর ও ক্যাম্পিং করার যায়গা।
- ওয়াচ টাওয়ার।
- মাতামুহুরী নদীতে নৌকা ভাড়া নিয়ে ঘুরে বেড়ানো।
- মিনঝিরি পাড়া ও সাদা পাহাড়।
- নদীর তীরে বসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ।
- পাহাড়ের চূড়ায় উঠে সকালের সূর্যোদয় কিংবা সন্ধ্যার সূর্যাস্ত উপভোগ করা।
- মেঘ দেখা।
ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
সুখিয়া ভ্যালি ভ্রমণের সেরা সময় কিংবা উপযুক্ত সময় হচ্ছে শীতকাল। নভেম্বর মাস থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সুখিয়া ভ্যালী ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত বা আদর্শ সময় বলা হয়ে থাকে। এই সময়ে আবহাওয়া ভ্রমণের জন্য আরামদায়ক থাকে এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য মন ভরে উপভোগ করা যায়।

কিভাবে যাবেন
সুখিয়া ভ্যালিতে যাওয়ার জন্য আপনি বাংলাদেশের যেকোনো জায়গা থেকে ভ্রমণে আসতে পারেন। এখানে আসার জন্য প্রথমে আপনাকে বান্দরবানের লামা উপজেলায় আসতে হবে।
এছাড়া রাজধানী ঢাকার আব্দুলাহপুর, সায়দাবাদ, গাবতলী, কল্যাণপুর থেকে শ্যামলী, এনা, এভারগ্রীন, হানিফ, সৌদিয়া, এমাদ কিংবা অন্য পরিবহনের বাসে করে কক্সবাজার যাওয়ার পথে চকরিয়া বাস টার্মিনালে নামতে পারেন। AC/Non-AC বাস ভেদে ভাড়া নিতে পারে ৮০০-২,০০০ টাকা। চকরিয়া বাস টার্মিনাল থেকে লামা-আলীকদম পথে জিপ, চান্দের গাড়ি, বাস বা সিএনজি করে সুখিয়া ভ্যালিতে যাওয়া যায়। জনপ্রতি ভাড়া নিতে পারে ৭০-১০০ টাকা। অথবা, লামা বাস টার্মিনাল থেকে জনপ্রতি ৩০ টাকা ভাড়ায় অটোতে করে চলে যেতে পারবেন সুখিয়া ভ্যালি।
আবার ঢাকা থেকে সরাসরি আলীকদমের বাসে করে লামা আসতে পারবেন। তবে যদি লামা আসতে না পারেন তাহলে ঢাকা থেকে কক্সবাজার গামী বাসে চকরিয়া এসে সেখান থেকে লামা যেতে পারেন।
যারা চট্টগ্রাম থেকে লামা যেতে চান তারা চাইলে বাসে বা ট্রেনে চট্টগ্রাম এসে নতুন ব্রীজ বাস স্ট্যান্ড থেকে চকোরিয়ায় যাবার বাসে করে যেতে পারেন। চট্টগ্রাম নতুন ব্রিজ বাস স্ট্যান্ড থেকে জনপ্রতি চকরিয়া যেতে ভাড়া লাগতে পারে ২০০-২৫০ টাকা মত।
কোথায় থাকবেন
আগেরি বলেছি যে সুখিয়া ভ্যালীতে মিরিঞ্জা ভ্যালির মত এতো রিসোর্ট, কটেজ কিংবা হোটেল নেই। তবে যা আছে তাতেও আপনি চাইলে থাকতে পারেন।
এখানে থাকার জন্য বেশ কিছু মাচাং ঘর / জুমঘর, কটেজ রয়েছে সাথে রয়েছে রিভারভিউ ইকো রিসোর্ট, সুখিয়া ভ্যালি ইকো রিসোর্ট। কাপল থেকে শুরু করে আপনারা যদি দলগত ভাবে যান এগুলোতে থাকতে পারেন। বড় কিছু জুমঘর রয়েছে যেখানে ১৫ থেকে ২০ জন অনায়াসে থাকতে পারবেন। ভাড়া নিতে পারে আনুমানিক ৪০০০ টাকা। কিছু কিছু জুমঘরে ৫ থেকে ৬ কিংবা ৮ জন করে থাকা যায়। ভাড়া নিতে পারে চাহিদার উপর ভিত্তি করে আনুমানিক ২০০০ টাকা। যদি ৪ জন থাকেন তাহলে ভাড়া ১৫০০-১৬০০ টাকা নিতে পারে। কাপলদের জন্য ভাড়া কিছুটা কম রয়েছে।
যদি আপনার প্ল্যান থাকে তাবুতে থাকা তাহলে সেটাও পারবেন। আপনি চাইলে যাওয়ার সময় সাথে করে তাবু নিয়ে যেয়ে থাকতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে তাদের ওয়াচ টাওয়ারে তাবু পিচ করতে হবে। তখন তাদেরকে ১৫০ টাকা পে করতে হতে পারে। আবার চাইলে তাদের থেকে তাবু ভাড়াও নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে তাবু ভাড়া নিতে খরচ করতে হবে ৩০০ টাকার মত। এক এক তাবুতে ২-৩ জনের মতো থাকা যায়।
তবে আরেকটু ভালো ভাবে থাকতে চাইলে লামা উপজেলা সদরে কিংবা মিরিঞ্জা অথবা মারাইংছা যেয়েও থাকতে পারবেন। এখানে বেশকিছু সাশ্রয়ী থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
বিঃদ্রঃ ছুটির দিনে ভ্রমণে গেলে যাবার আগে যোগাযোগ করে যাবেন।
কোথায় খাবেন
এখানে খাবারের জন্য কটেজ রয়েছে। আপনি কটেজ থেকে প্যাকেজ আকারে খাবার নিতে পারবেন। প্যাকেজে অনুমানিক খাবার মেনু থাকে এরকম: সকালের নাস্তায় দিবে ডিম খিচুরি। দুপুরে খাবারে থাকবে সাদা ভাত, সবজি, মুরগি ও ডাল। সন্ধায় থাকবে চা-বিস্কিট ও রাতের খাবারে দেশী মুরগি / মাছ দিয়ে ভাত,সবজি, ডাল কিংবা চাইলে রাতের মেনু পরিবর্তন করে বারবিকউ করতে পারেন, তখন চিকেনের সাথে আনলিমিটেড পরাটা থাকবে। জনপ্রতি খাবের প্যাকেজ এর মূল্য নিতে পারে ৬০০-৭৫০ টাকা।
আরও: বাংলাদেশের ৬৪ জেলার বিখ্যাত খাবারের তালিকা
কিছু দরকারি টিপস
লামার এই ভ্যালিতে ভ্রমণে জন্য কিছু দরকারি টিপস মাথায় রাখতে পারেন। এতে আপনার ভ্রমণ হবে আরও নিরাপদ এবং আনন্দময়।
- লামা বাজারে সেনাবাহিনী চেকপোস্ট রয়েছে। তাই সঙ্গে অবশ্যই জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি রাখবেন।
- পাহাড়ে চলাফেরার সময় সতর্ক থাকুন।
- পাহাড়ে একাকী চলাফেরা করবেন না। বিশেষ করে রাতে একা চলাফেরা করা ঠিক নয়।
- স্থানীয় জনগণের সংস্কৃতি ও পরিবেশের প্রতি সম্মান দেখান।
- প্রয়োজনীয় ওষুধ, অতিরিক্ত কিংবা পাহাড়ে চলার মত জুতো সাথে রাখুন, হালকা খাবার, পাওয়ার ব্যাংক এবং পর্যাপ্ত পানি সঙ্গে রাখা ভালো।
- যদি আপনি ট্র্যাকিং করেন তাহলে ট্র্যাকিংয়ের সময় ভালো গ্রিপের জুতা ও মাস্ক সঙ্গে রাখুন।
- নৌকা ভাড়া করার সময় কি কি স্পট ঘুরে দেখাবে তা ভাল করে জেনে নিন।
- স্থানীয় খাবার খেতে ভুলবেন না তবে, যে সব খাবার খেলে আপনার পেট কিংবা শরীর খারাপ করতে পারে সেসব খাবার এড়িয়ে চলুন।
- হাল্কা ঢিলেঢালা জামা পরিধান করুন।
- আপনার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিরাপদ স্থানে রাখুন।
আরও: ভ্রমণ টিপস
ফেসবুক: Kuhudak



Add your first comment to this post
You must be logged in to post a comment.