ভ্রমণের জগতে একটা কথা প্রায়ই শোনা যায় “সকল ট্রেকারই ট্রাভেলার, কিন্তু সকল ট্রাভেলার ট্রেকার নন।” এই কথাটার মধ্যে যেন একরাশ অভিজ্ঞতা, এক চিলতে দার্শনিকতা আর ভ্রমণজীবনের বাস্তবতাও লুকিয়ে আছে। প্রথমে শুনলে মনে হতে পারে, খুব সাধারণ একটা বাক্য। কিন্তু একটু গভীরে গেলে বোঝা যায়—এটা আসলে দুটি আলাদা মনোভাব, দুটি আলাদা পথের গল্প।
আরও: ট্রাভেলে বাংলাদেশের সম্ভাবনা
ট্রাভেলার মানে কি?
একজন ট্রাভেলার মানেই তিনি ভ্রমণপ্রেমী। ঘর থেকে বেরিয়ে নতুন কিছু দেখার, জানার, অনুভব করার টানে যিনি রাস্তায় নামেন, তিনি ট্রাভেলার। কারও কাছে ভ্রমণ মানে হতে পারে শহরের ক্যাফে কালচার উপভোগ করা, কারও কাছে পুরোনো স্থাপত্য দেখা, কেউবা স্রেফ পাহাড় দেখে সময় কাটাতে চান। কেউ রিসোর্টে আরাম করে থাকেন, কেউ ছোট গ্রাম ঘুরে বেড়ান। তাদের প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা আলাদা, কিন্তু সবাই-ই এক অর্থে ভ্রমণ করছেন।
ট্রেকার কারা?
ট্রেকাররা ভ্রমণ করেন একটু ভিন্ন ধাঁচে। তারা রাস্তায় হাঁটেন, তবে সেটা কেবল শহরের পথ নয়—হতে পারে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা ট্রেইল, কিংবা ঘন জঙ্গলের ভেতরকার জনমানবহীন পথ। পিঠে ব্যাগ, হাতে ট্রেকিং স্টিক আর চোখে থাকে গন্তব্যে পৌঁছানোর তীব্র আগ্রহ। ট্রেক মানে শুধু হাঁটা নয়, একরকম মানসিক প্রস্তুতি, একাগ্রতা আর প্রকৃতিকে গভীরভাবে উপলব্ধির চেষ্টা।
পার্থক্যটা কোথায়?
যারা শুধু ঘুরতে ভালোবাসেন, তারা ট্রাভেলার। কিন্তু যারা ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি নিজের অবস্থান পরীক্ষা করতে চান, শারীরিক কষ্টকে আলিঙ্গন করতে পারেন, তারা ট্রেকার।
একজন ট্রাভেলার হয়তো ঝর্ণা দেখতে গিয়ে তার পাদদেশেই দাঁড়িয়ে থাকেন। আর একজন ট্রেকার সেই ঝর্ণার উৎস খুঁজে ৫ ঘণ্টার পথ হেঁটে পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠে যান।
এখানেই দুই অভিজ্ঞতার পার্থক্য।
কেন সকল ট্রেকারই ট্রাভেলার?
ট্রেকিং নিজেই একধরনের ট্রাভেল—তফাৎ শুধু ভ্রমণের ধরনে। একজন ট্রেকার নতুন জায়গায় যান, প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করেন, নতুন মানুষ, সংস্কৃতি, পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হন। ট্রাভেলের যেসব মৌলিক উপাদান আছে, সবই ট্রেকিং-এ থাকে। বরং অনেক সময় ট্রেকারদের অভিজ্ঞতা আরও গভীর হয়, কারণ তারা প্রকৃতির সবচেয়ে কাঁছে, অপ্রচলিত রূপটার সঙ্গে মুখোমুখি হন।
কিন্তু সকল ট্রাভেলার কেন ট্রেকার নন?
সবাই ট্রেক করতে পারে না, বা চায় না। কারও হয়তো শারীরিক অসুবিধা আছে, কেউ হয়তো নিরুদ্বিগ্ন অবকাশ যাপন পছন্দ করেন। কেউ হয়তো পাহাড়ের কষ্ট সহ্য করতে পারেন না, আবার কারও প্রাধান্য হয় শহরের বিলাসবহুল হোটেল, রেস্টুরেন্ট আর সানসেট ভিউ পয়েন্ট। এই ভিন্নতা একদমই স্বাভাবিক। ভ্রমণের অর্থ শুধু চড়াই-উৎরাই নয়, কখনো কখনো সেটা নরম বালুর উপর হাঁটাও হতে পারে।
দুই অভিজ্ঞতার সৌন্দর্য
ভ্রমণের আসল সৌন্দর্যই এখানেই—যে যার মতো করে নতুন কিছু আবিষ্কার করে। কেউ হয়তো ৩০ কিমি হেঁটে বরফে ঢাকা একটি পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস নেন, আর কেউ হয়তো ক্যাফেতে বসে স্থানীয়দের সঙ্গে গল্প করে একটা শহরের প্রাণ খুঁজে পান। দুজনই ভ্রমণ করছেন, দুজনের পথ আলাদা, কিন্তু গন্তব্য—একটাই: নিজের ভেতরের মানুষটার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন।
এই লেখার উদ্দেশ্য কাউকে শ্রেষ্ঠ বা শ্রেষ্ঠতর বলা নয়। বরং বোঝানো যে ভ্রমণ নানা রকমের হতে পারে, তার কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। ট্রেকাররা একটু বেশিই ঘাম ঝরান, একটু বেশিই হাঁটেন, একটু বেশিই কষ্ট সহ্য করেন। তাই তারা নিঃসন্দেহে ট্রাভেলার। কিন্তু সকল ট্রাভেলার সেই কষ্ট নিতে রাজি নন এবং তাদের না-থাকার অধিকারও আছে।
তবে হ্যাঁ, যদি আপনি কখনো ট্রেক করার সুযোগ পান, একবার চেষ্টা করে দেখতে পারেন। কে জানে, হয়তো প্রকৃতির সেই গভীর আহ্বান আপনাকেও একজন ট্রেকারে পরিণত করে ফেলবে!
ইউটিউব: Kuhudak



Add your first comment to this post
You must be logged in to post a comment.